আসন্ন বসন্তের বেহালাবাদক
রেহানা বীথি
বিশাল এক বট গাছ। ডাল, পাতা আর ঝুলন্ত ঝুরিতে হিজিবিজি অবস্থা। পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল লাল ফলগুলো বেশ নজর কাড়ার মতো হলেও, কারও নজরই কাড়ছে না। কেন কাড়ছে না- আশাকরি তা একটু পরেই সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
গাছটির বয়স যে কত তা কেউ জানে না। এ তল্লাটের সবচেয়ে বৃদ্ধ যে ব্যক্তি, যার দেহের ইঞ্চি ইঞ্চি ত্বকে কোটি কোটি ভাঁজ, সে পর্যন্ত জানে না ওটার বয়স। বটবৃক্ষের বয়স না জানুক, তল্লাটের লোকজন এটুকু জানে, বড় কিংবা ছোট, যেকোনও জমায়েতে সবাইকে একত্রিত হতে হবে এই গাছটির নিচেই। হয়-ও। আজও হয়েছে।
খুব বড় নয়, ছোটখাটো একটা জমায়েত হয়েছে আজ। জনা বিশেক বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ এবং শিশু গাছটির নিচে গোলাকার হয়ে উচ্চস্বরে এমন কিছু কথা বলছে, যেগুলো হাসির উপাদানে ভরপুর। ওরা কথা বলছে, এ ওর গায়ে গুঁতো মারছে আর ঢলে ঢলে পড়ছে।
শুধু দু’জন ছাড়া। একজন চনমনে যুবক আর তার বাঁ হাতের মধ্যমা শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বছর দশেকের শিশু। ওরা নিশ্চুপ। কিন্তু নিশ্চুপ হলেও ওদের চোখ-মুখের অভিব্যক্তি একেবারেই স্পষ্ট। এই স্পষ্টতা ওদের দৃঢ়তারই প্রকাশ। নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে যে ওদের বিন্দুমাত্র কোনও সংশয় নেই, তা জানিয়ে দিয়ে ওরা সেই যে চুপ মেরেছে তো মেরেইছে। তারপর থেকে এই জমায়েতের দীর্ঘ হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তা আর হাসাহাসি ওদেরকে এতটুকুও স্পর্শ করছে না। এমনকি হাসাহাসির মূলে যে ওরাই, তা নিয়েও ওদের কোনও ভাবান্তরই নেই।
গোলাকার জমায়েতের একেবারে কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে যুবক আর তার আঙুল ধরা শিশুটি। পেশীবহুল তামাটে গাত্রবর্ণ যুবকের। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, শক্ত চোয়াল। এহেন দেহসৌষ্ঠবের একজন যুবকের চোখদুটো ভীষণ মোলায়েম। যেন ঘোরলাগা শিশুর মতো সরল চাহনি। ওর পরনে হাঁটু অব্দি গুটিয়ে গিঁট দেয়া একখণ্ড গেরুয়ারঙ কাপড়, গায়েও ওই রঙেরই ঢিলেঢালা হাতাবিহীন ফতুয়া। শিশুটির গায়ের রঙ,পোশাক যুবকটির কাছাকাছি তবে ও-স্বাভাবিক কারণেই পেশীহীন। ওরা দু’জন বন্ধু।
অনিমেষ এবং নেত্র, যথাক্রমে যুবক আর শিশুটির নাম। অনিমেষ গোঁ ধরেছে, ও-একটা আর্জি নিয়ে রানির কাছে যাবে। বন্ধু হিসেবে নেত্র’র পূর্ণ সমর্থন আছে তাতে। আর তাই নিয়েই প্রথমে মৃদু গুঞ্জন, পরে এই জমায়েত এবং হাসাহাসি। আর্জিটা প্রেম সম্বন্ধীয়। হাসাহাসি সে কারণেই বেশি। তাছাড়া… কোথাকার কোন এক অখ্যাত অনিমেষ, সে কী না আর্জি নিয়ে যাবে রানির কাছে! তা-ও আবার প্রেম সম্বন্ধীয়! ছেলেটা বলে কী! রাজপ্রাসাদে ঢোকা কি এত সহজ? আর রানির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আর্জি পেশের খায়েশ, সে-ও কি সহজ ভেবেছে ওই নালায়েক? গর্দান যাওয়ার কথা কি একবারও ওর মনে আসছে না? এমন সব হাজারও প্রশ্নে জমায়েত মুখর। দেখতে দেখতে জমায়েতে লোকসংখ্যা বাড়ছে। মুখরতায় অংশ নিয়ে সবাই শেষ সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, যুবকের মাথা থেকে এমন আর্জি এবং তা নিয়ে রানির কাছে যাওয়ার চিন্তা ঝেড়ে ফেলা উচিত। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ও দু’জন গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। কোনও নড়চড় নেই। যাবে তো যাবেই। এবং আজই। যদিও জমায়েত শুরু হয়েছে সেই ভোরে, আর এখন শীতের বেলা প্রায় ঢলোঢলো, তবুও আজই যাবে। এহেন গ্যাঁট অবস্থা থেকে অনিমেষ এবং নেত্রকে নিরস্ত করতে যখন সবার সব চেষ্টা ব্যর্থ, তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে কোটি ভাঁজওয়ালা সেই বৃদ্ধ, যাকে সবাই এ জনপদের প্রধান বলেই মানে, এগিয়ে এলেন। বললেন,
“যেতে চাইছো ভালো কথা, তবে যে আর্জি নিয়ে যাবে, তা আরেকবার ভেবে দেখো।”
অনিমেষ বলল, “অনেক তো ভেবেছি, আর কেন?”
“তবু… এই যে প্রেম নেই বলছো, তা তো পুরোপুরি ঠিক নয়। তাছাড়া প্রেম আছে তো আছে, তা সবসময় অত বলে বেড়ানোর মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই, বুঝলে? ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসে অত মুগ্ধ হওয়ারও কিছু নেই।”
“আমি মানবো কেন? আপনাদের মনে হয় বলে কি আমারও তেমন মনে হবে? আপনারা তো বলছেন, জীবনে একটু আধটু প্রেম থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু মুগ্ধতার দরকার নেই। ওসব নাকি অলসদের কাজ। অলসদের কোনও কাজ থাকে না বলে নাকি ওরা বসে বসে যা দেখে, তা দেখেই মুগ্ধ হয় আর প্রেমে পড়ে। এতে নাকি তাদের কাজ করার স্পৃহা এত কমে যায় যে, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এটা কোনও কথা হল? মুগ্ধ হওয়া যাবে না? নতুন করে কোনও প্রেম আসবে না জীবনে?
” না আসবে না। তোমার পূর্বপুরুষরা এভাবেই তাদের জীবন অতিবাহিত করেছেন, করছেন। এই যে জনপদ দেখছো, কোনওকিছুরই অভাব নেই। ক্ষেত ভরা ধান, ভুট্টা, গম, নানান পদের সবজি। রয়েছে আধুনিক কৃষিখামার। অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানকার সমৃদ্ধি ঈর্ষনীয়। যে ইমারতগুলো আমরা গড়ে তুলেছি, অন্যরা তা পারেনি। অন্যদের মতো যদি আমরা ফুল, পাখি, গাছপালা দেখে শুধু মুগ্ধ হয়েই সময় কাটাতাম, শুধু প্রেম নিয়েই ভাবতাম, তাহলে কি এতসব হতো? ওগুলো মনের খোরাক। তাতে পেট ভরে না। এই জনপদ এবং এরকম আরও দশটি জনপদ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই দেশ। প্রেম নয়, প্রয়োজনে অস্ত্রের ব্যবহারে সমৃদ্ধি অর্জন করতে হয়। মেধা এবং বিচক্ষণতা দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলতে হয় শক্ত ভীত। যা আমাদের রানি করেছেন। অতএব তাঁর কাছে এমন আর্জি নিয়ে যাওয়া বোকামি। এখন ঘরে ফিরে যাও।”
এতসব কথায় অনিমেষ আর নেত্রের কোনও ভাবান্তরই হল না। ওরা আগের মতোই স্থির দাঁড়িয়ে রইল। জমায়েতের গুঞ্জন বাড়ছে ধীরে ধীরে। পুরো জমায়েতে একবার চোখ ঘুরিয়ে অনিমেষ বলল, “হোক বোকামি, তবু আমরা যাবো। আশেপাশের দেশের মানুষের কাছে শুনি, ওদের দেশে নাকি ফুলে ফুলে মৌমাছি বসে। গাছে গাছে পাখিরা মধুর সুরে গান গায়। ভারি সুন্দর সুন্দর রঙ গায়ে মেখে নাকি প্রজাপতিরা উড়ে বেড়ায়। কিন্তু আমাদের দেশে ওসব কোথায়? আকাশে রামধনুও দেখি না কখনও।”
একথা শুনে জমায়েতে কেমন একটা শোরগোল উঠল। কেউ কেউ মাথা নেড়ে সাঁয় দিল এবং এমনটি কেন, এই প্রশ্নও তুলল কেউ কেউ। তবু কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করল না। অনিমেষ আবারও বলল,
“এসব নেই বলেই এত সমৃদ্ধ আমাদের এই দেশ, এই জনপদ কেমন রুক্ষ দেখুন। যেন কোনও কিছুতেই প্রাণ নেই। কোনও উচ্ছাস নেই। নদীর জলও কেমন অবসন্ন গতিতে বয়ে যায়, কুলকুল শব্দ ওঠে না। উঠবে কী করে? বাতাসও তো আনন্দ নিয়ে কোমল পরশ বুলিয়ে দেয় না নদীর জলে। যেন সেটাও বারণ। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার প্রকৃতিও যেন নিষেধের বেড়াজালে বন্দি। এ অবিচার তো আমরাই করেছি প্রকৃতির ওপর। আমরা মুগ্ধতাকে কৌটোবন্দি করে প্রেমের স্বাভাবিক যে গতি, তাকে আটকে দিয়েছি। প্রকৃতিও ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রেম বর্জিত জীবন নিয়ে বেশিদিন সুস্থ থাকা যায় না।”
বৃদ্ধ এবার বেশ উত্তেজিত হয়েই বললেন, “এসব পাগলের প্রলাপ। তুমি যে একটা পাগল তা তো তোমার আচরণেই স্পষ্ট। ওইটুকু এক পুঁচকে বাচ্চা যার বন্ধু, যে কিনা কাজকর্ম বাদ দিয়ে ওই দুধের শিশুর সঙ্গে মাঠে-ময়দানে ঘুরে বেড়ায়, সে পাগল নয় তো কী? এত বয়স হল, তবু ছোট্ট এক ছেলের আঙুল ধরে রাতদিন ধেই ধেই, আর গান গেয়ে বেড়ানো। তারওপর ক’দিন ধরে এই নতুন উপদ্রব, দেশে নাকি হারানো মুগ্ধতা ফিরিয়ে আনবে। ফিরিয়ে এনে সবাইকে প্রেমে পড়ার মন্ত্র শেখাবে। একেবারে যা-তা!
কী হবে মুগ্ধ হয়ে? বড়জোর কবিতা টবিতা, তাছাড়া আর কিচ্ছুটি হবে না, বুঝলে?”
“কবিতারও কিন্তু একটা জাদুকরী শক্তি আছে। দেখবেন?” বলে অনিমেষ নেত্রকে ইশারা করল। ও-যেন তৈরিই ছিল। ফতুয়ার পকেট থেকে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ বের করে বন্ধুর হাতে দিল। অনিমেষ ভাঁজ খুলে পড়তে যাবে, এমন সময় বৃদ্ধ বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠলেন,
“তুমি কি কবিতাও লেখো নাকি হে? কবিতা মানে মুগ্ধতার প্রকাশ, মানে প্রেম? এ দেশে বাস করে এত সাহস তোমার হয় কী করে? রানি জানলে তোমার তো প্রাণ যাবেই, সঙ্গে সঙ্গে এ তল্লাটের সবাইকেই নিশ্চিহ্ন করে দেবেন।”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেসে অনিমেষ বলল, “তা তো না-ও হতে পারে! বলেছি না, কবিতার একটা জাদুকরী শক্তি আছে? আমি যদি রানির সামনে গিয়ে এ কবিতা পড়ি, হয়তো মুহূর্তেই উনি অতীত ভুলে যাবেন। হয়তো প্রথমবারের মতো উঠে যাবে মুগ্ধতার ওপর থেকে সবরকম নিষেধাজ্ঞা। আমরা আবারও প্রেম নিয়ে ভাববো। যা দেখবো, তাই দেখেই মুগ্ধ হবো আর মুহুর্মুহু প্রেমে পড়বো!”
কিছুক্ষণ আগের মিলিয়ে যাওয়া হালকা শোরগোলটা আবারও জেগে উঠল। বেশ জোরেশোরেই সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই, কী এমন আছে ওই কবিতাতে, যা কিনা যুগ যুগ ধরে প্রেমবিহীন এ দেশে প্রেম ফিরিয়ে দেবে? অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল অনিমেষের কাছে। কারও কারও চোখ সামান্য আর্দ্র। ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠল,
“সত্যি সত্যিই কি এমন হওয়া সম্ভব? যদি হয়, আমরা তোমার সঙ্গে আছি। যাও তুমি, রানি নিশ্চয়ই তোমার আর্জি মেনে নেবেন।”
উপস্থিত জমায়েত কলকল করে একাত্মতা ঘোষণা করল। বৃদ্ধ এই একাত্মতার কাছে ভীষণ অসহায় বোধ করলেও আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন৷ এমন সময় ভিড় থেকে ভেসে এল নতুন এক কণ্ঠস্বর,
“শুনেছি… একসময় এ দেশে সব ছিল। ফুলে মৌমাছি, পাখিদের গান, প্রজাপতির রঙ, ঢেউয়ের গুনগুন, সব। বৃষ্টি শেষে রোদ উঠলেই আকাশে রামধনু ভেসে উঠতো। মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, ঘাসের কচি ডগায় মুগ্ধ হয়ে প্রেম লেপ্টে থাকতো। তারপর…! থাক, ওসব আর নাই বা বললাম। যেতে চাইছো যাও। কেন যেন মনে হচ্ছে প্রেম আসলেই বড় দরকারি। বড় বড় ইমারত নয়, কুঁড়ের চালে ঝিঙেফুল হেসে উঠুক। আমাদের দেহ-মন আজ বড় তপ্ত। জুড়ানো প্রয়োজন।”
সবাই বলল, ঠিক ঠিক। ওদের দেখাদেখি বৃদ্ধের চোখেও সেই কোন সুদূর অতীতের স্মৃতিগুলো দুলতে লাগলো। ঠিক তখনই, ওই দূ…র পাহাড়, যেটার মাথায় সূর্য লটকে থাকে সারাদিন, মনে হল, সেখান থেকে ঘন কুয়াশা ফুঁড়ে ছিটকে বেরিয়ে আসছে এক আলোর রেখা। তার সাথে সাথে ভেসে আসছে অসংখ্য ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠল সবাই। লক্ষণ ভালো নয়! রানির সৈন্যবাহিনী। কিন্তু কেন? অনিমেষ তো আর্জি নিয়ে এখনও যায়নি!
ধীরে ধীরে আওয়াজ আর আলোর রেখা নিকটবর্তী হয়ে দৃশ্যমান হল সৈন্যদল। অবাক হয়ে উপস্থিত জমায়েত তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পেল, সৈন্যদলের ঠিক মাঝামাঝি একটি সুসজ্জিত বিশেষ শকট, যা কেবলমাত্র রানিকেই বহন করে। অবিশ্বাস্য এ দৃশ্য সকলের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। ওরা কেউ-ই বুঝতে পারলো না, সৈন্যদলসহ রানি কখন একেবারে তাদের কাছে এসে থেমে গেছে। শকট থেকে নেমে রানি যখন অঙুলি নির্দেশ করে বললেন,
“এই যুবকটিই কি অনিমেষ?” তখন সবার সম্বিৎ ফিরে এল। কিন্তু সবাই চুপ। এক অজানা আশঙ্কায় কেউই অনিমেষকে দেখিয়ে দিতে প্রস্তুত নয়। অনিমেষই একসময় বলল, “আমিই অনিমেষ, মহামান্যা রানি!”
ভীষণ কোমল এক হাসি ফুটে উঠল রানির মুখে। এগিয়ে এসে তিনি অনিমেষের কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, “শুনলাম, তুমি নাকি আমার কাছে একটা আর্জি নিয়ে যাবে? এ দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রেম ফেরতের সে আর্জির কথা শুনে আমি বিশেষ কৌতূহলী। অভিনব সেই আর্জির বিস্তারিত জানতে তাই নিজেই ছুটে এলাম। শোনাও দেখি তোমার আর্জি।”
“আমার বন্ধুর আর্জি পেশের আগে আমি একটা জিনিস দেখাতে চাই মহামান্যা রানি!”
রানি অনিমেষের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ করে কোমল এক শিশুকণ্ঠ শুনে তিনি বেশ অবাক হয়ে নেত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বন্ধু? তুমি অনিমেষের বন্ধু!”
“একদম মহামান্যা! আমরা দু’জন বন্ধু।” বলল নেত্র। অনিমেষও মাথা নেড়ে সাঁয় দিল।
“কী সুন্দর… কী মিষ্টি আর কী অভিনব ব্যাপার! আমি এমনটি কখনও দেখিনি! অবশ্য দেখলাম-ই বা কী, শুধু রাজ্য, রাজত্ব আর তার সমৃদ্ধির কলাকৌশল ছাড়া! তোমাদেরকে দেখে আমার এত ভালো লাগছে! ইচ্ছে করছে, তোমাদের বন্ধু হই। জানো, প্রাসাদে কেউ কারও বন্ধু নয়। ওখানে কেউ-ই তোমাদের মতো করে ভাবতে পারে না। এই যে যুগ যুগ ধরে একটি দেশে প্রেম নেই, মুগ্ধ হওয়ার চোখও নেই কারও, তা নিয়ে কেউ একবারও কোনও প্রশ্ন তোলেনি। মানে, কেউ ভাবেইনি। না থাকাটাকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিল সবাই। আমিও। সে কারণেই তো যখন অনিমেষের কথা শুনলাম, স্থির থাকতে পারলাম না।”
বলে একটু থামলেন রানি। তারপর নেত্র’র মাথায় হাত বুলিয়ে অসম্ভব মিষ্টি করে বললেন, “কই, দেখি, তুমি কি দেখাতে চাও?”
নেত্র’র হাতে ধরাই ছিল ভাঁজ করা কাগজখানা। ভাঁজ খুলে রানির হাতে দিতে দিতে ও-বলল, “আমার বন্ধুর লেখা কবিতা এটা। পড়ে দেখুন, মহামান্যা রানি!”
যেন বিশ্বাসই করতে পারছেন না, এমনভাবে চমৎকৃত হয়ে রানি ওটা হাতে নিলেন। হাতে নিয়ে মধুর কণ্ঠে সুর করে পড়তে লাগলেন…
“জানি, আবার একজন বেহালাবাদকের
প্রেমে পড়ে যাবো আসন্ন বসন্তে।
নিখাদ বিরহকথা, তারে কম্পমান করুণসুর
আমাকে বার বার নিশিকাতর করতে করতে
দোয়াতের হলদে কালিতে
লিখে ফেলবে একটি হাজারপৃষ্ঠার চিঠি
আমি, আকাশে পেতে রাখা শষ্পশয্যায়
মৃত্তিকার গন্ধ নেবো
আর নদীর জলে
ঢেলে দেবো বাসন্তী আদর…”
অনিমেষ, নেত্র এবং উপস্থিত জমায়েত বুঁদ হয়ে শুনতে শুনতে দেখতে পেল, মহামান্যা রানির গালবেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিশুদ্ধ নোনাজল…